আপডেট: ০২:০৩, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
| প্রিন্ট সংস্করণ
|
[ ]
পূর্ণিমা মালো ভাত রান্না করছিলেন। জয়পুর মিশনারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবনের সামনের মাঠে ইউক্যালিপটাসগাছের সারি। অদূরে
বেশ কয়েকটি তাঁবু। গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাণিজ্যিক খামার থেকে উচ্ছেদ
করা সাঁওতাল পূর্ণিমা ও তাঁর সঙ্গীদের আপাতত আশ্রয় এসব তাঁবুতে। তাঁবুর
সামনে বানানো চুলায় রান্না বলতে ভাত আর শাক সেদ্ধ বা কলাই সেদ্ধ।
গত রোববার রাত তখন নয়টা। হাড় কাঁপানো শীত। ঘন কুয়াশা আর
জমাট বাঁধা অন্ধকার। আলো কেবল চুলার আগুন আর এর–ওর হাতের মুঠোফোনের টর্চ।
উচ্ছেদের পর মাস দেড়েক ধরে খোলা আকাশের নিচে নাওয়া-খাওয়া আর তাঁবুতে বাস
চলছে সাঁওতালদের।
পূর্ণিমার বাড়ি দিনাজপুর জেলার চিতল গ্রামে। তিনি বললেন,
সেখানে স্বামী ও ছেলেমেয়েরা আছে। সাহেবগঞ্জ খামারে তাঁর পৈতৃক জমি উদ্ধারে
সপরিবারে গত জুনে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল–অধ্যুষিত মাদারপুর
গ্রামে আসেন। জুলাইয়ে অন্যদের সঙ্গে তিনিও সাহেবগঞ্জ খামারে দুটি ঘর
তুলেছিলেন। ৬ নভেম্বর রাতে পুলিশ সাহেবগঞ্জ খামারে সাঁওতালদের বসতি উচ্ছেদ
করার পর এই তাঁবুতে বাস করছেন। ছেলেমেয়েরা দিনাজপুর ফিরে গেছে। মাঝে মাঝে
আসে। সেখানে অন্যের জমিতে ঘর তুলে পূর্ণিমারা থাকেন। তিনি পড়ে আছেন সরকার
যদি খামারে তাঁদের একটু জায়গা করে দেয়, সেই পুনর্বাসনের আশায়।
তাঁবুতে বাস করা অন্যদেরও একই দাবি—পুনর্বাসন। এ জন্য এই
শীতেও কষ্টে চলছে তাঁবুতে বাস। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ডোমার হাসদা দৃঢ় কণ্ঠে
বললেন, তাঁদের পৈতৃক ভিটা থেকে সরকার উচ্ছেদ করেছে। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা
না করা পর্যন্ত তাঁরা এখান থেকে যাবেন না।
সাঁওতালরা এই তাঁবু-ত্রিপল পেয়েছে বিভিন্ন সংস্থা থেকে
ত্রাণ হিসেবে। ঘুরে দেখা গেল, বড় জয়পুর গ্রামের মাঠে, মিশনারি স্কুল মাঠে
আর মাদারপুর গির্জার সামনে ও আশপাশে তাঁবু ফেলা হয়েছে। আর ত্রিপল দিয়ে তৈরি
করা হয়েছে টানা লম্বা ছাপরা ঘর। সব মিলিয়ে শ দেড়েক। ভেতরে খড় বিছিয়ে তার
ওপর পাতা ত্রাণের কম্বল। এক পাশে গুটিকয় হাঁড়ি-পাতিল আর চাল-ডাল, কাপড়চোপড়
ইত্যাদি। এসবও ত্রাণের। তবে ভেতরে-বাইরে পরিবেশ বেশ পরিচ্ছন্ন।
সবাই এসেছে বাইরে থেকে: কথা বলে জানা
গেল, তাঁবু ও ত্রিপলের ছাপরা ঘরে থাকা সাঁওতালরা এসেছে বাইরে থেকে।
সাহেবগঞ্জ খামারের পাশে মাদারপুর, বড় জয়পুর ও ছোট জয়পুর—এই তিন গ্রাম নিয়ে
মূলত সাঁওতালপল্লি। পল্লিতে কিছু গবাদিপশু লুট হওয়া ছাড়া বড় হামলা হয়নি। এই
পল্লিতে প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবারের বাস। তাদের ঘরবাড়ি মাটির। বাড়িতেই
তারা রয়েছে।
রোববার ও গতকাল সোমবার পল্লির আশপাশের তাঁবুগুলোতে দেখা
গেছে, এগুলোতে তিন থেকে সাড়ে তিন শ সাঁওতাল রয়েছে। কথা হলো জয়পুরহাটের
চাংগুড়া গ্রামের রবি সরেন, বেলপুকুর গ্রামের বিমল মুর্মু, কংগ্রেস মাড্ডি,
পীরগঞ্জের চোতরা গ্রামের লুসিয়া মাড্ডি, লুকাস হেমব্রন, দিনাজপুরের
ঘোড়াঘাটের বাহা মাড্ডি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বুড়ি টুডু, রুথিনা কিসকু,
পাঁচবিবির তারামনি মুর্মুসহ অনেকের সঙ্গে। তাঁরা বললেন, ২০১৩ সালে
সাহেবগঞ্জ খামারের ভূমি উদ্ধারের জন্য আন্দোলন শুরু হলে তাঁদের নেতারা
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সাঁওতালপল্লিতে গিয়ে তাঁদের আন্দোলনে অংশ নিতে বলেন।
তাঁরাও একজন, দুজন করে আন্দোলনে যোগ দিতে আসেন।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিল আহমেদ ও জাতীয়
পার্টির নেতা শাজাহান মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৪ সালে ‘সাহেবগঞ্জ
বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটি’ গঠন করা হয়। সাঁওতালদের
মধ্যে ফিলিমিন বাস্কে ছিলেন ৪১ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটির সহসভাপতি। এই
কমিটির পক্ষ থেকে গত ১ জুলাই খামারের হরিণমারী, সাহেবগঞ্জ, মাদারপুর ও
কুয়ামারায় চারটি বড় বসতি করা হয়। প্রায় ৪০০ পরিবার ছিল সেখানে। অধিকাংশই
ছিল বাইরে থেকে আসা। ৬ নভেম্বর এই বসতি উচ্ছেদের সময় যে তিন সাঁওতাল নিহত
হন, তাঁদের মধ্যে শ্যামল হেমব্রনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবং মঙ্গল মাড্ডির
বাড়ি ঘোড়াঘাটে। অপর নিহত রমেশ সরেনের বাড়ি সাপমারায়।
৬ নভেম্বর রাতে পুলিশ সাঁওতালদের বসতি
উচ্ছেদ করার পর তাঁবুতে বাস করছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, পুনর্বাসনের
ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তাঁরা এখান থেকে যাবেন না
উচ্ছেদের পর এসব বহিরাগত খামারের পাশে মূল সাঁওতালপল্লির
মাদারপুর গির্জা ও মিশনারি স্কুলের সামনে অবস্থান নেয়। শীতের তীব্রতা বাড়ায়
এবং খাবারের অভাবে বহিরাগত সাঁওতালদের পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য নিজ
এলাকায় ফিরে গেছে। পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে এক বা দুজন সাহেবগঞ্জে আছে।
তবে বাইরে থেকে লোকজন গেলে বা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গেলে মূলপল্লির সাঁওতাল আর
বহিরাগত সাঁওতালরা এমনভাবে মিশে যায় যে তখন চট করে আলাদা করা যায় না। মনে
হয়, অনেক মানুষ তাঁবুতে বসবাস করছে।
মামলা ও গ্রেপ্তার: উচ্ছেদের পর ৬
নভেম্বর রাতেই পুলিশ ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৩০০-৪০০ জনের
বিরুদ্ধে মামলা করে। এ মামলায় গ্রেপ্তার করা চার সাঁওতাল পরে জামিনে মুক্তি
পান। অন্যদিকে ১৭ নভেম্বর স্বপন মুর্মু অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনের বিরুদ্ধে
মামলা করেন। এ মামলায় ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। থোমাস হেমব্রম ২৬ নভেম্বর
আরেকটি মামলা করেন।
এদিকে ১৪ ডিসেম্বর উচ্চ আদালত ১৫ দিনের মধ্যে ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে নির্দেশ দিয়েছেন।
সুষ্ঠু তদন্ত চান: সাঁওতালদের দাবি,
তাদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। মাদারপুরের
হিবুল সরেন বললেন, স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও থানার
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) উপস্থিতিতে তাঁদের ঘরবাড়িতে হামলা হয়েছে। এই
কর্মকর্তারা গোবিন্দগঞ্জে থাকলে সুষ্ঠু তদন্ত হবে না। হামলায় জড়িত
কর্মকর্তাদের অপসারণ করে হাইকোর্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার যে নির্দেশ
দিয়েছেন, সেভাবে তদন্ত করতে হবে।
যোগাযোগ করলে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আবদুস সামাদ
বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাকে জানানো হয়নি। বিচার বিভাগ তাঁদের মতো করে তদন্ত
করবেন। এর সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’
গোবিন্দগঞ্জের সাংসদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘উচ্চ আদালত
বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। স্থানীয় ইউএনও বা থানার ওসির পক্ষে
এই পর্যায়ের তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ নেই। তদন্ত নিরপেক্ষ
হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’
ধান আছে স্কুলের ঘরে: সাহেবগঞ্জ খামারে
সাঁওতালরা যে রোপা আমন ধান চাষ করেছিল, উচ্চ আদালতের নির্দেশে তা কেটে
তাদের দেওয়া হয়েছে। রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় মেশিন দিয়ে ২৪
নভেম্বর ধান কাটা শুরু হয়। শেষ হয় ৪ ডিসেম্বর। মোট ৫৫০ বস্তা ধান প্রশাসনের
উপস্থিতিতে সাঁওতালদের দেওয়া হয়। মাদারপুরের সাঁওতালদের গ্রামীণ সমিতির
সম্পাদক সুবাস মুর্মু বললেন, সব ধান আপাতত জয়পুর মিশনারি স্কুলের কয়েকটি
ঘরে রাখা হয়েছে। ধান মাপা হয়নি। তবে মেশিন দিয়ে যেনতেনভাবে ধান কাটায় অনেক
ধান জমিতে নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, সাঁওতালদের মধ্যে এখনো ভয়ভীতি বিরাজ
করছে। ধান সেদ্ধ, শুকানোর মতো পরিবেশও আপাতত নেই। পরিস্থিতি একটু
স্বাভাবিক হলে ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে বিক্রি বা বণ্টন—যা হোক, কিছু করা হবে।
0 comments:
Post a Comment