উপসম্পাদকীয়
জি. মুনীর
২০ নভেম্বর ২০১৬,রবিবার, ১৮:৫৭
সাঁওতালেরা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন উপজাতি জনগোষ্ঠী। প্রধানত এদের বসবাস রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুর জেলায়। বিভিন্ন সূত্র মতে, বাংলাদেশে সাঁওতালদের সংখ্যা বিভিন্ন। তবে একটি সূত্র মতে, ১৯৮৪ সালের জরিপে বাংলাদেশে এদের সংখ্যা দেড় লাখের মতো। জানা যায়, এ উপমহাদেশে এদের আদিবাস ছিল ভারতের সাঁওতাল পরগনার ছোটনাগপুর। এরও আগে এরা অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে ভারতে প্রত্যাবাসিত হয় ১০ হাজার বছর আগে। নৃতত্ত্ববিদেরা এদের চিহ্নিত করতে চান ‘প্রটো-অস্ট্রোলয়েড’ নৃগোষ্ঠী হিসেবে। এই নৃগোষ্ঠীর লোকেরা মূলত ছিল শিকারি। মধ্য-পূর্ব ভারতের বনাঞ্চলে বসবাস করে এরা পশুপাখি শিকার করেই জীবন ধারণ করত। এখনো আমাদের দেশের সাঁওতালদের মধ্যে এই প্রবণতা কিছুটা হলেও লক্ষ করা যায়। কালক্রমে সাঁওতালদের জনসংখ্যা বেড়ে যায় এবং বনাঞ্চল উজাড় হতে থাকে। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রধানত ব্রিটিশরাজ চলার সময় এরা সেখান থেকে বাংলাদেশ অঞ্চলসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে- মূলত কাজের সন্ধানে। এসব কাজের মধ্যে ছিল কৃষিকাজ, বন কেটে কৃষিজমি তৈরি ও রেলপথ নির্মাণ। জমিদারেরাও এদের কাজে লাগিয়েছে কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে। প্রসঙ্গত একটি কথা বলে নেয়া দরকার, আমাদের দেশের কিছু কিছু গণমাধ্যমে ও কিছু লেখকের লেখায় এদের বাংলাদেশের একটি আদিবাসী গোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করলেও বাংলাদেশে এরা আদিবাসী নয়। তবে স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সাঁওতালেরাই সবচেয়ে প্রাচীন উপজাতি গোষ্ঠী। প্রকৃতপক্ষে এরা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী।
এই যদি হয় বাংলাদেশের সাঁওতালদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, তবে নিঃসন্দেহে ধরে নেয়া যায়, ভারতে এদের বসবাস হাজার হাজার বছর, আর বাংলাদেশে শত শত বছর। বাংলাদেশে যাদের বসবাস শত শত বছর, নিশ্চিতভাবেই এরা নিরন্তর এ মাটির সন্তান। বাংলাদেশ এদের পবিত্র জন্মভূমি, মাতৃভূমি। এরা এ দেশের আর দশজন নাগরিকের মতোই যাবতীয় নাগরিক অধিকার পাওয়ার দাবিদার। আর যা হোক, শত শত বছর ধরে একটি দেশে বসবাস করে এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর লোকেরা যদি স্থায়ী বসত গড়ে তোলার নিশ্চিত ঠাঁই না পায়, তবে সংখাগুরু শাসকগোষ্ঠীর জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে? অধিকন্তু অস্থায়ীভাবে থাকতে দেয়া স্থান থেকে তাদের উচ্ছেদ করতে সরকারের কোনো সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে এদের প্রাণ দিতে হয়, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়, ক্ষেতের ফসল লুটে নেয়া হয়, আর সে কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাদের; তখন তা গোটা জাতির জন্য কোনো ভালো খবর হতে পারে না। আমরা জাতি হিসেবে এই সংখ্যালঘুদের জন্য একটি বসতভিটার স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিতে পারলাম না, এ ঘটনা এটাই প্রমাণ করে, এরা এ দেশে নাগরিক হিসেবে কতটুকু বঞ্চনার শিকার।
কথাগুলো বলছিলাম, গত ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের সাথে সাঁওতালদের বহুলালোচিত ঘটনার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে। তখন ওই সংঘর্ষের ঘটনায় সাঁওতালদের বাড়িঘর ও ক্ষেতের ফসল লুটপাট হয়। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। সংঘর্ষে তিন সাঁওতাল নিহত হন। কেউ কেউ হন গ্রেফতারের শিকার। জানা যায়, ১৯৫২-৫৪ সালের দিকে সাঁওতাল ও আশপাশের মুসলমান ও হিন্দুদের কাছ থেকে সরকার চিনিকলের জন্য এক হাজার ৮৮২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। ২০০৪ সালে চিনিকল লে-অফ ঘোষিত হলে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে সাহেবগঞ্জ খামারের জমি চিনিকল কর্তৃপক্ষ চাষাবাদের জন্য লিজ দেয়। বেশির ভাগ জমির লিজ পান আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর ভাই লিটন চৌধুরী। জমি অধিগ্রহণের সময় বলা হয়েছিল, চিনিকলের আখ চাষের জন্য এই জমি লিজ অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কথা ছিল এই জমিতে আখ চাষ না হলে জমি মূল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে। লিজ ব্যবহারকারীরা এই জমিতে আখের বদলে অন্য ফসল চাষ করাসহ এই জমি সাবলিজ দেয়ায় সাঁওতালেরা এ ফার্মের জমিতে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়।
এই যদি হয় বাংলাদেশের সাঁওতালদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, তবে নিঃসন্দেহে ধরে নেয়া যায়, ভারতে এদের বসবাস হাজার হাজার বছর, আর বাংলাদেশে শত শত বছর। বাংলাদেশে যাদের বসবাস শত শত বছর, নিশ্চিতভাবেই এরা নিরন্তর এ মাটির সন্তান। বাংলাদেশ এদের পবিত্র জন্মভূমি, মাতৃভূমি। এরা এ দেশের আর দশজন নাগরিকের মতোই যাবতীয় নাগরিক অধিকার পাওয়ার দাবিদার। আর যা হোক, শত শত বছর ধরে একটি দেশে বসবাস করে এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর লোকেরা যদি স্থায়ী বসত গড়ে তোলার নিশ্চিত ঠাঁই না পায়, তবে সংখাগুরু শাসকগোষ্ঠীর জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে? অধিকন্তু অস্থায়ীভাবে থাকতে দেয়া স্থান থেকে তাদের উচ্ছেদ করতে সরকারের কোনো সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে এদের প্রাণ দিতে হয়, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়, ক্ষেতের ফসল লুটে নেয়া হয়, আর সে কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাদের; তখন তা গোটা জাতির জন্য কোনো ভালো খবর হতে পারে না। আমরা জাতি হিসেবে এই সংখ্যালঘুদের জন্য একটি বসতভিটার স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিতে পারলাম না, এ ঘটনা এটাই প্রমাণ করে, এরা এ দেশে নাগরিক হিসেবে কতটুকু বঞ্চনার শিকার।
কথাগুলো বলছিলাম, গত ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের সাথে সাঁওতালদের বহুলালোচিত ঘটনার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে। তখন ওই সংঘর্ষের ঘটনায় সাঁওতালদের বাড়িঘর ও ক্ষেতের ফসল লুটপাট হয়। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। সংঘর্ষে তিন সাঁওতাল নিহত হন। কেউ কেউ হন গ্রেফতারের শিকার। জানা যায়, ১৯৫২-৫৪ সালের দিকে সাঁওতাল ও আশপাশের মুসলমান ও হিন্দুদের কাছ থেকে সরকার চিনিকলের জন্য এক হাজার ৮৮২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। ২০০৪ সালে চিনিকল লে-অফ ঘোষিত হলে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে সাহেবগঞ্জ খামারের জমি চিনিকল কর্তৃপক্ষ চাষাবাদের জন্য লিজ দেয়। বেশির ভাগ জমির লিজ পান আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর ভাই লিটন চৌধুরী। জমি অধিগ্রহণের সময় বলা হয়েছিল, চিনিকলের আখ চাষের জন্য এই জমি লিজ অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কথা ছিল এই জমিতে আখ চাষ না হলে জমি মূল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে। লিজ ব্যবহারকারীরা এই জমিতে আখের বদলে অন্য ফসল চাষ করাসহ এই জমি সাবলিজ দেয়ায় সাঁওতালেরা এ ফার্মের জমিতে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়।
এ দিকে দৈনিক যুগান্তরে গত ১৭ নভেম্বরে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, এই হামলার জন্য দায়ী আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপিসহ ১৬ জনকে চিহ্নিত করেছে সাঁওতালেরা। এদের কেউ হামলার ইন্ধনদাতা, কেউ পরিকল্পনাকারী, আবার কেউ সরাসরি হামলা ও অগ্নিসংযোগে অংশ নিয়েছেন। সাঁওতাল নেতারা জানান, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তারা এ তালিকা প্রশাসন, আদিবাসী ও মানবাধিকার সংগঠনসহ যেখানে প্রয়োজন সেখানেই সরবরাহ করবেন। গত বুধবার এই তালিকা পত্রিকাটির হাতে পৌঁছে। সাঁওতালদের অভিযোগ মতে, হামলায় সরাসরি ইন্ধন দিয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, সাপমারা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ, কাটাবাড়ি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিক ও মহিমাগঞ্জ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধান। আর সাপমারা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন হামলার পরিকল্পনাকারী। আগুন দেয়ার সময় সুগারমিলের গার্ড ভুলু, আলম ও লতিফ এবং ওয়াচম্যান বাবুলকে চিনতে পেরেছেন সাঁওতালেরা। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ফুকু হোসেন, রুহুল আমিন, মিজানুর রহমান, হেলাল, লখিমুদ্দিন, নুরুল ও মানাজ উদ্দিন পুলিশের সামনেই আগুন দিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য ধরে এদের চিহ্নিত করেছে সাঁওতালেরা।
সাঁওতালদের বসতবাড়ির ওপর এই হামলার ঘটনা নিয়ে ষড়যন্ত্রের গুটি চালাচালির এখনো শেষ হয়নি বলেই মনে হয়। জানা গেছে, ঘটনার ১১ দিন পর গত ১৭ নভেম্বর গভীর রাতে সাঁওতালদের পক্ষ থেকে গোবিন্দগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা পাঁচ-ছয় শ’ লোককে আসামি করে একটি রহস্যময় মামলা করা হয়েছে। এই মামলা দায়েরের পর সাঁওতাল পল্লীতে নতুন করে আবারো সৃষ্টি হয়েছে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অপর দিকে বাঙালি গ্রামগুলোর পুরুষেরা গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ যাকে পাচ্ছে তাকেই গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে।
জাতীয় গণমাধ্যমগুলোর খবরে জানা যায়, সাঁওতাল পল্লীর লোকজন এই মামলা নিয়ে বিস্মিত হয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, সাহেবগঞ্জ ইক্ষুখামার এলাকায় সাঁওতালদের ওপর হামলার ঘটনায় যারা সরাসরি জড়িত, যারা ইন্ধনদাতা ও যারা নিরীহ সাঁওতালদের হাত থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, সেসব প্রভাবশালীকে মামলায় আসামি করা হয়নি। এটি আবার নতুন কোনো ফন্দি-ফিকির বা ষড়যন্ত্র কি না, এমন শঙ্কায় তারা শঙ্কিত। এ দিকে রহস্যময় এই মামলা দায়েরের পরপরই পুলিশ দ্রুত অভিযানে নেমে পড়েছে। মামলার পরদিন বৃহস্পতিবার আটক করা হয় তিনজনকে। ফলে গ্রফতার আতঙ্কে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের পুরুষেরা এখন ঘরছাড়া। এ ব্যাপারে মাদারপুর গ্রামের ভুবন মার্ডি বলেন, আমরা কেউ জানি না, এ মামলা কিভাবে হলো। তা ছাড়া আমাদের ওপর এ হামলা হয়েছে প্রকাশ্যে। এ মামলায় কেন অজ্ঞাতনামা আসামি হবে? যদি কোনো মামলা হয়ে থাকে, তবে সেটা রহস্যময়। মাদারপুর গ্রামের একাধিক সাঁওতালের দাবি, চিহ্নিত দোষীদের বাঁচাতে এই মামলা করা হয়েছে। এই মামলা ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে করা হয়নি। সাহেবগঞ্জ ইক্ষুখামার জমি উদ্ধার কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাফায়েল হাসদার বলেছেন, এই মামলা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। কী উদ্দেশ্যে এবং কার স্বার্থে এ মামলা করা হয়েছে, সেটা তিনিই ভালো জানেন, যিনি মামলা করেছেন। তার বাড়ি কোথায়, সেটাও আমরা জানি না। জমি উদ্ধার কমিটি সহসভাপতি ফিলিমন বাস্কের দাবি, অতি উৎসাহী হয়ে মূল ঘটনা আড়াল করার জন্য স্বপন মরমু নামের জনৈক আদিবাসী কারো প্ররোচনায় এ মামলটি করেছেন। স্বপন মরমু ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ নন। তাকে আমরা চিনি না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সাঁওতালদের বাপ-দাদার অধিগ্রহণ করা এই জমি প্রভাবশালীরা হাতিয়ে নেয়ার গভীর ষড়যন্ত্র সূত্রেই ঘটছে সাঁওতালবিরোধী এসব নানামাত্রিক ঘটনা। গত শনিবারের দৈনিক যুগান্তরের এক সরেজমিন প্রতিবেদনে সে সত্যিই প্রতিফলিত। পত্রিকাটির সরেজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলার নেপথ্যে রয়েছে রংপুর সুগারমিলের খামারের জমির নিয়ন্ত্রণ। দু’জন ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী সেখানকার জমি লিজ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে চাষাবাদ ও মাছ চাষ করে আসছিলেন। সাঁওতালেরা তাদের জমি দখলে নেয়ায় তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে। এ ছাড়া স্থানীয় এমপি দখল করা জমি ছেড়ে দিতে সাঁওতালদের ওপর চাপ দিয়ে আসছিলেন। কথা না শোনায় সাঁওতালদের ওপর ক্ষুব্ধ হন এমপি আবুল কালাম আজাদ। উল্লেখ্য, দুই বছরে সাঁওতালেরা অনেক জমি নিয়ন্ত্রণে নেয়। চলতি মওসুমে খামারের কমপক্ষে ৫০০ একর জমি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সাঁওতালেরা চাষাবাদ শুরু করে। এসব জমি ১১ বছর প্রভাবশালীদের ভোগদখলে ছিল। এই ১১ বছর খামারের এক হাজার ৫০২ একর জমি পর্যায়ক্রমে প্রভাবশালীরা লিজ নিয়ে চাষাবাদ ও মাছ চাষ করে। জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার লিজ বাতিল করলে প্রভাবশালী মহল ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
বাস্তবতা হচ্ছে, এই জমি আকাশ থেকে পড়েনি। এই জমি কারো না কারো মালিকানায় ছিল। তাদের কাছ থেকেই সরকার অধিগ্রহণ করেছে রংপুর চিনিকলের ইক্ষু ফার্মের জন্য। চিনির কল লে-অফ ঘোষিত হওয়ার এই জমি ফেরত পেলে জমির আদি মালিকেরাই পাবে, এটাই স্বাভাবিক। আর চুক্তির শর্তও তাই বলে। এখন এই জমি প্রভাবশালীদের দখলে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ হিসাব শিশুও বোঝার কথা। কিন্তু বুঝতে চায় না শুধু এই লোভাতুর প্রভাবশালীরা।
এ দিকে গত শনিবার সচেতন নাগরিক সমাজ ঢাকায় ‘গাইবান্ধায় সাঁওতালদের ওপর অমানবিক নির্যাতনে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগ পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা ও নাগরিকের করণীয়’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এই সংবাদ সম্মেলনে সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে জানান, ‘সরকারের মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে অনেকে মিডিয়ার সামনে বলেছেন এই জমি কখনো সাঁওতালদের ছিল না। এটি সম্পূর্ণ অসত্য ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল। আমরা যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো- ‘এটি সাঁওতাল ও স্থানীয় গরিব মানুষের বাপ-দাদার জমি। আমরা এই জমির খতিয়ানের কপি পেয়েছি।’
সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, ‘১৯৬২ সালের ৭ জুলাই তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের সাথে সুগারমিল কর্তৃপক্ষের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কপি আমরা পেয়েছি। সেই চুক্তিতে স্পষ্ট বলা আছে, আখ চাষের জন্য এই জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। যদি ভবিষ্যতে কখনো আখ চাষ না করা হয় বা আখ ছাড়া অন্য কিছু চাষ হয়, তবে এই জমি উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে খরচ হলে তাও সরকার দেবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ আছে। লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, ‘চুক্তিতে বলা হয়েছে, এই জমির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি জমির আইল পর্যন্ত পরিবর্তন করা যাবে না। অথচ সুগারমিল কর্তৃপক্ষ এ জমি নানা কাজে লিজ দিয়েছে। আমাদের কাছে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের একটি কপি এসেছে। এ দরপত্রের বিজ্ঞাপনের (২০১৫ সালের ১ এপ্রিল) ১১টি পুকুর ও ১২টি প্লটের জন্য দরপত্র চাওয়া হয়েছে। এটি পুরোপুরি চুক্তির লঙ্ঘন।’
সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, জমি অধিগ্রহণের সময় মৌজা ও খতিয়ানের নামের সাথে মানুষের নামও লেখা আছে। মানুষের নামের ৭৫ শতাংশ সাঁওতাল। সাড়ে পাঁচ হাজার বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর সাড়ে চার হাজার বিঘাই সাঁওতালদের।
এখন চিনিকল এই জমি ব্যবহার না করলে অন্যদের লিজ বা ফেরত দিলে সাঁওতালদের জমি সাঁওতালদের হাতেই দিতে হবে। কোনো মতেই লোভাতুর অন্য কোনো গোষ্ঠীর কাছে নয়। সাঁওতালেরা সেই ন্যায্য দাবিই করছে। তারা তাদের বাপ-দাদার জমিতেই পুনর্বাসন চায়, অন্য কোনো জমিতে নয়। তারা চায় না তাদের চোখের সামনে তাদের বাপ-দাদার জমি দখলদারদের হাতে চলে যাক। সরকারের উচিত সেই কাজটুকুই সাঁওতালদের জন্য করে দেয়া। পাশাপাশি এর বাইরের গরিব হিন্দু ও মুসলমানদের জমিও প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। এটি অন্যায় কোনো দাবি নয়।
সবশেষে আরেকটি কথা- এখনো যথাযথ পুনর্বাসনের অভাবে সাঁওতালেরা দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। দ্রুত তাদের পুনর্বাসনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
0 comments:
Post a Comment