
গাইবান্ধার
গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ঘরবাড়িতে পুলিশ আগুন দিয়েছে বলে যে ভিডিও চিত্র
পাওয়া গেছে তার স্থিরচিত্র। ছবি : বাংলা ট্রিবিউন
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ
উপজেলায় রংপুর চিনিকলের ইক্ষু খামারে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে গত ৬ নভেম্বর
পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে তিন
সাঁওতাল মারা যায়। গুলিবিদ্ধ হয় আরো চারজন। সাঁওতালদের ছোড়া তীরে আহত হন ৯
পুলিশ সদস্য। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে খামারের জমি
থেকে সাঁওতালদের বসতি উচ্ছেদ করে। এ সময় তাদের বসত-ঘরগুলো আগুনে পুড়িয়ে
দেওয়া হয়। পুলিশ সদস্যরাই এসব বসতিতে আগুন দিয়েছিলেন বলে প্রথম থেকেই
অভিযোগ করছে সাঁওতালরা। সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনের হাতে এ ধরনের একটি
ভিডিওচিত্র এসেছে। তাতে এসব বাড়িঘরে আগুন লাগাতে দেখা গেছে পুলিশ সদস্যদের।
তবে আগুন দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ।বাংলা ট্রিবিউনের কাছে আসা তিন মিনিট ৩১ সেকেন্ডের ভিডিওচিত্রের শুরুতে দেখা গেছে, পুলিশ সদস্যরা রাস্তা ধরে সাঁওতালদের বসতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ২০ সেকেন্ড পর দেখা যায় সাঁওতালদের বাড়ির সামনে গিয়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্য কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি ছুড়ছেন। পোশাক পরা পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের গায়ে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট দেখা গেছে।
ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, সেখানে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা সাঁওতালদের ঘরে লাথি মারতে থাকেন। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য সাঁওতালদের কুঁড়েঘরের খড় হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়তে থাকেন। ৩৫ সেকেন্ডের দিকে দেখা যায়, এক পুলিশ সদস্য একটি কুঁড়েঘরের খড়ে লাইটার জ্বেলে আগুন লাগানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু লাইটার দিয়ে আগুন লাগাতে পুরোপুরি সফল না হওয়ায় তাঁকে সাহায্য করতে গোলাপি টি-শার্ট পরা আরেক ব্যক্তি এগিয়ে যান এবং দেয়াশলাই জ্বালিয়ে সাঁওতালদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেন। এরপর দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে ঘরে। পরে সাদা পোশাকের একজন গিয়ে আগুন ভালোভাবে ধরেছে কি না তার তদারকি করেন। এরপর মুহূর্তে পুরো ঘরে আগুন লেগে যায়। পুলিশ সদস্যরা এরপর সেখান থেকে আগুন নিয়ে সাঁওতালদের অন্য ঘরগুলোতেও ধরিয়ে দেন।
ভিডিওচিত্রের এক মিনিট ২৭ সেকেন্ডের দিকে দেখা যায়, আগুন লাগানো ঘরগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটছেন পুলিশ সদস্যরা। এক মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের দিকে দেখা যায়, অনেক ঘর আগুনে পুড়ছে, গবাদি পশুগুলো চিৎকার করে ছুটছে।
ভিডিওচিত্রের দুই মিনিট ৩০ সেকেন্ডের দিকে দেখা যায়, সাঁওতালদের বসতিতে আগুন লাগলেও তা নেভানোর চেষ্টা করছেন না কোনো পুলিশ সদস্য। তাঁদের সামনেই ঘরগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তিন মিনিট ২৮ সেকেন্ডের দিকে দেখা যায়, আগুনে দাউদাউ করে পুড়ছে অনেক ঘর।
সাঁওতালদের উচ্ছেদ অভিযান প্রসঙ্গে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত সরকারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গোবিন্দগঞ্জের পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। সেদিন থানা পুলিশ, জেলা পুলিশ, র্যাব—সবাই ওই অভিযানে অংশ নিয়েছিল। আগুন নেভোনোর জন্য দমকল বাহিনীকে খবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আসার আগেই সব পুড়ে যায়।’
পুলিশ সদস্যরা আগুন দিয়েছে—এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সুব্রত সরকার বলেন, ‘পুলিশ আগুন দিয়েছে—এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।’
এ প্রসঙ্গে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘পুলিশ এ ঘটনার জন্য দায়ী। সাঁওতালদের পক্ষ থেকে মামলা হলেও পুলিশ কাউকে আটক করেনি। বরং এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। নিরীহ লোকজনকে ধরছে। অপরাধীদের ধরতে পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই।’
সংঘর্ষের ঘটনায় গোবিন্দগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক কল্যাণ চক্রবর্তী বাদী হয়ে ৬ নভেম্বর রাতেই ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে ৩৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। পুলিশ চার সাঁওতালকে গ্রেপ্তারও করে, পরে তারা জামিনে মুক্তি পায়।
হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুট ও উচ্ছেদ ঘটনায় গত ১৬ নভেম্বর স্বপন মুর্মু নামের এক সাঁওতাল বাদী হয়ে ৬০০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি দেখিয়ে সাঁওতালদের পক্ষে মামলা করেন। এ মামলায় ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সাঁওতালদের দাবি, তারা স্বপন নামে কাউকে চেনে না।
এ ছাড়া ২৬ নভেম্বর দুপুরে সাঁওতালদের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত থোমাস হেমব্রম বাদী হয়ে স্থানীয় এমপি, ইউএনও ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০-৬০০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় দেখিয়ে থানায় একটি এজাহার দাখিল করেন। সেটি এখনো তদন্তাধীন আছে।
এ ঘটনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে তদন্ত প্রতিবেদন দেন গাইবান্ধার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুস সামাদ। গত ২৮ নভেম্বর গাইবান্ধার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দাখিল করা ২৪ পাতার প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে শিল্পসচিবকে দেওয়া একটি চিঠি। তাতে বলা হয়, সাঁওতালদের দাবি আর রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যাখ্যা প্রমাণ করে গাইবান্ধার সাঁওতালরা এখনো ৭০০ একর জমির মালিক। কারণ আখ চাষের জন্য সাঁওতালদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করা হলেও শর্ত ভঙ্গ করে ওই জমি লিজ দেওয়া হয় এবং আখ চাষ না করে তাতে অন্য ফসল চাষ করা হয়।
হামলার পর থেকেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে শত শত সাঁওতাল পরিবার। এই পরিবারগুলোর কেউ কেউ খামারের পাশে সাঁওতালপল্লী মাদারপুর গির্জার সামনের মাঠে কলাগাছের পাতা দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট কুটুরি বানিয়ে, কেউ ত্রাণে পাওয়া তাঁবু টানিয়ে কোনোরকমে ঠাঁই নিয়ে আছে। অনেকে থাকছে পরিত্যক্ত স্কুলঘরে খড় বিছিয়ে।
http://www.kalerkantho.com/home/printnews/440539/2016-12-13
0 comments:
Post a Comment